মানসিক রোগকে অনেকে ‘এটা তার মস্তিষ্কের শয়তানি’ বলে চূড়ান্ত রায় দিয়ে দেন, তারা এটাকে ব্যাধি হিসেবে স্বীকারই করতে চান না। কিন্তু মানসিক অসুস্থতা আসলেই ব্যাধি এবং এটি সম্পর্কে অনেকেরই ভুল ধারণা আছে, যা মানসিক রোগীর জীবনকে আরো বিপর্যস্ত করতে পারে। এ প্রতিবেদনে মানসিক অসুস্থতা সম্পর্কে ১০টি ভুল ধারণা দেওয়া হলো।
* ভুল ধারণা: মানসিক অসুস্থতা বাস্তব না
যেহেতু মানসিক অসুস্থতার ক্ষতি বাইরে থেকে দেখা যায় না, তাই অনেক লোক মানসিক স্বাস্থ্য ব্যাধির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এটি শুধুমাত্র ভুল ধারণা নয়, এটি প্রকৃতপক্ষে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগা লোকদের জন্য অপমানকর ও অমর্যাদাপূর্ণ, বলেন মেন্টাল হেলথ আমেরিকার মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড সিস্টেমস অ্যাডভোকেসির ভাইস প্রেসিডেন্ট ডেবি প্লটনিক। মানসিক অসুস্থতাও প্রকৃত অসুস্থতা যা গুরুত্ব সহকারে নেওয়া উচিত এবং এ ব্যাধির যৌক্তিকতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশের মানে হচ্ছে এ সমস্যায় ভোগা লোকেরা অভিনয় করছে বা ভান করছে জাতীয় কিছু বোঝানো, যা মানসিক রোগীকে আরো বেশি লজ্জিত করে এবং তারা তাদের প্রয়োজনীয় সাহায্য পাওয়া থেকে দূরে থাকে।
* ভুল ধারণা: আমার পরিচিত কোনো মানসিক রোগী নেই
মানসিক অসুস্থতা আপনার ধারণার চেয়েও বেশি কমন এবং আপনার অজ্ঞাতেই হয়তো আপনার পরিচিত কেউ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় জর্জরিত হচ্ছে। মেন্টাল হেলথ গভের মতে, ৫ জন আমেরিকানের মধ্যে একজন কোনো মানসিক সমস্যায় ভুগে এবং ২৫ জন আমেরিকানের মধ্যে একজন তীব্র মানসিক অসুস্থতায় (যেমন- শিজোফ্রেনিয়া অথবা বাইপোলার ডিসঅর্ডার) জর্জরিত। এছাড়া প্রতিবছর ৪০,০০০ লোকের জীবনে ডিপ্রেশন হানা দেয়, যা আত্মহত্যার প্রধান কারণ। এই পরিসংখ্যান এটা প্রমাণ করেছে যে, মানসিক অসুস্থতাকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
* ভুল ধারণা: শিশুদের মানসিক রোগ হয় না
অনেক লোক ভাবে না যে, শিশুরাও মানসিক সমস্যায় ভুগতে পারে। অথচ মানসিক অসুস্থতার আনুমানিক ৫০ শতাংশ ১৪ বছর বয়সে শুরু হয়। যদিও তাদের অনেকের এ অসুস্থতা নির্ণীত হতে অনেক বছর লেগে যেতে পারে। মানসিক অসুস্থতা যে কারো যেকোনো বয়সে হতে পারে।
* ভুল ধারণা: মানসিক রোগ চিকিৎসায় ভালো হয় না
কিছু লোক ধারণা করেন যে মানসিক স্বাস্থ্য ব্যাধির বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা (যেমন- ওষুধ, থেরাপি ও অন্যান্য) অকার্যকর। কিন্তু প্লটনিক বলেন যে, এসব ট্রিটমেন্ট অবিশ্বাস্য কার্যকর বা ফলদায়ক, বিশেষ করে অসুস্থতার প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা আরম্ভ হলে। চিকিৎসা ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি ভিন্ন হতে পারে, এটি ওয়ান-সাইজ-ফিটস-অল থেকে দূরে। কিন্তু এই ব্যাধির বিভিন্ন ট্রিটমেন্ট অপশনের মানে হচ্ছে, প্রত্যেক রোগী কোনো না কোনো থেরাপি খুঁজে পেতে পারে যা তাকে ভালো অনুভবে সাহায্য করবে।
* ভুল ধারণা: মানসিক অসুস্থতা খুব খারাপ না হওয়া পর্যন্ত চিকিৎসা করা উচিত নয়
মানসিক অসুস্থতায় ভোগা লোকেরা চিকিৎসা নেবে কিনা এ নিয়ে প্রায়সময় দ্বিধাগ্রস্ত থাকে। তারা মনে করে যে, এটি থেরাপি ও ওষুধ নেওয়ার মতো যথেষ্ট খারাপ হয়নি। কিন্তু প্লটনিকের মতে, এটি সম্পূর্ণরূপে ভুল ধারণা। আপনি যত তাড়াতাড়ি এর চিকিৎসা করবেন এ সমস্যা থেকে তত দ্রুত মুক্তি পেতে পেতে পারেন। মেন্টাল হেলথ ফার্স্ট এইড কলোরাডো অনুসারে, চিকিৎসা শুরু করার সবচেয়ে কার্যকর সময় হচ্ছে তীব্র সাইকোটিক এপিসোডের অভিজ্ঞতা হওয়ার পূর্বে ১২ থেকে ১৭ বছর বয়স। এই সমস্যার প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা করলে এরকম মারাত্মক পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশে কমে যাবে এবং এই অসুস্থতা নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে।
* ভুল ধারণা: পাপের কারণে মানসিক অসুস্থতা হয়
মানসিক অসুস্থতা কোনো ব্যক্তির পাপ বা দোষের ফল নয়। এটি যে কারো হতে পারে- তার বয়স কত, তার লিঙ্গ কি, সে কোন গোষ্ঠী বা জাতির বা শ্রেণীর এটা কোনো ব্যাপার নয়। মানসিক অসুস্থতার জন্য অপরাধবোধ বা লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই। বলা হয়ে থাকে যে, কারো মানসিক অসুস্থতা কারো ব্যক্তিগত দুর্বলতা বা দোষ থেকে হয়ে থাকে, মানসিক রোগীদের প্রতি এরকম অপবাদ আরোপণ তাদেরকে মানসিকভাবে আরো বিপর্যস্ত করে তোলে। রোগীকে দোষারোপ না করে এর ফ্যাক্টর খোঁজা উচিত, যেমন- জেনেটিক, নিম্নমানের খাবার অথবা জীবনের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন।
* ভুল ধারণা: মানসিক সমস্যা গোপন রাখা উচিত
যেহেতু মানসিক অসুস্থতা সম্পর্কে অনেক মানুষের নেতিবাচক ধারণা (স্টিগমা) রয়েছে, তাই অনেক রোগী ভাবে যে তাদের অবস্থা গোপন রাখাটাই সবচেয়ে ভালো হবে। প্লটনিক বলেন যে, স্টিগমা দূর করার জন্য জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে এবং সবাইকে এটা বোঝাতে হবে যে মানসিক অসুস্থতার সঙ্গে কারো আত্মমর্যাদা হ্রাসের সম্পর্ক নেই। মানসিক সমস্যা লজ্জা পাওয়ার মতো কোনো বিষয় নয়। এ সমস্যা গোপন না রেখে বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
* ভুল ধারণা: মানসিক রোগীরা আগ্রাসী
একটি স্টেরিওটাইপ ধারণা হচ্ছে, মানসিক রোগের রোগীরা অত্যধিক হিংস্র ও আগ্রাসী, কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে অন্য কথা। মেন্টাল হেলথ আমেরিকা অনুসারে, ৯৫ থেকে ৯৭ শতাংশ ভয়ানক অপরাধ সংঘটিত হয় মানসিক অসুস্থতা নেই এমন লোকদের দ্বারা। প্লটনিক বলেন যে, অধিকাংশ মানসিক রোগী কখনো হিংস্র আচরণ করে না। মেন্টাল হেলথ ডট গভ নিশ্চিত করেছে যে, যারা তীব্র মানসিক সমস্যায় ভুগছেন তাদের পূর্বে ভায়োলেন্সের অভিজ্ঞতা হওয়ার সম্ভাবনা ১০ গুণ বেশি।
* ভুল ধারণা: মানসিক রোগ প্রতিরোধ করা যায় না
মানসিক অসুস্থতার হার দিনদিন বেড়ে চলেছে এবং এটি যে কাউকে আক্রমণ করতে পারে- তাদের রিস্ক ফ্যাক্টর যেমনই হোক না কেন। কিন্তু প্লটনিক বলেন যে, কোনো মানসিক রোগের ঝুঁকি হ্রাসের জন্য অসংখ্য উপায় রয়েছে। মায়ো ক্লিনিকের মতে, মানসিক অসুস্থতা প্রতিরোধের একটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হচ্ছে- নিজের স্বাস্থ্য ট্র্যাক করা, মানসিক অসুস্থতার কোনো লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে কিনা খেয়াল করা এবং নিয়মিত চেকআপের জন্য চিকিৎসকের কাছে যাওয়া। স্বাস্থ্যসম্মত লাইফস্টাইল মেনে চলা, পর্যাপ্ত ঘুম যাওয়া, ভালো খাওয়া এবং নিয়মিত এক্সারসাইজও মানসিক অসুস্থতা বিকাশের ঝুঁকি হ্রাস করবে।
* ভুল ধারণা: মানসিক অসুস্থতার জন্য পিতামাতা দায়ী
যখন কোনো শিশুর মধ্যে মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ প্রকাশ পেতে শুরু করে, অনেকে এর জন্য পিতামাতাকে দোষী ভাবেন। প্লটনিক এর বিরোধিতা করে বলেন, সাধারণত পরিবার হচ্ছে কোনো মানসিক অসুস্থতার শিশুকে সাপোর্ট দেওয়ার শক্তিশালী উৎস এবং প্রায়ক্ষেত্রে তারাই প্রথমে শিশুর অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ্য করে। পরিবারের কোনো ট্রমা, যেমন- মৃত্যু বা বিয়েবিচ্ছেদ, কোনো শিশুর মানসিক অসুস্থতা বিকাশের ঝুঁকি বাড়াতে পারে, কিন্তু এই অসুস্থতা পেরেন্টিং মেথডের কোনো প্রত্যক্ষ ফলাফল নয়।